বাঁশী, বাংলাদেশ এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট
বাঁশী, শব্দটি শুনলে প্রথমেই আপনার কি মনে হয়? “রাতের বেলা দূর থেকে ভেসে আসা কোন সুর”, “গ্রামের রাখালের নিত্য সঙ্গী”, “কৃষ্ণের বাহন” কিংবা “ বৈশাখী মেলায় নিত্য-পণ্য”। বাংলাদেশে বসে আপনি হয়তো ভাববেন “এই নিতান্তই শখের পণ্য”, যা “ সংস্কৃতির ধারক” নাকি অযথা সময় নষ্ট, ছেলেমানুষি, হয়তো সঙ্গীতের ব্যাপারে আপনার ধারনা বা আগ্রহ সীমিত। কিংবা তা না হলেও আপনি “বংশীবাদক” বলতে বুঝেন টেলিভিশনের পর্দায় গায়ক গায়িকার পাশে একজন যন্ত্রানুবাদকে । আবার হয়তো ভাবেন নিতান্তই সল্প আয়ের দরিদ্র মানুষের পেশা এটি।
কারন আপনি হয়তো জানেন না, বাঁশীর ইতিহাস ৩৫,০০০ থেকে ৪৫,০০০ বছরের পুরানো। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে আদি বাদ্যযন্ত্র।
আপনি হয়তো জানেন না Folk Flute এবং Classical Flute এর পার্থক্য, জানেন না শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপযোগী করতে একটা সাধারণ লোকজ বাদ্যযন্ত্র থেকে কত গবেষণা করে এর ক্ষমতাকে বাড়ানো হয়েছে । আর তা করেছেন বাংলাদেশেরই একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং বংশীবিশারদ পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ । যার জন্ম এই বাংলাদেশেই।
আপনি কোন বংশীবাদককে যদি চিনেনও তা হয়তো আপনার পরিচিত কোন ব্যক্তিকে, চিনেন না চৌরাসিয়াকে।
সমাজের খুব ছোট অংশই বাঁশীর বিশাল জগৎ সম্পর্কে জানেন। বাংলাদেশের মতো জায়গায় যেখানে সঙ্গীত চর্চার অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এবং সংস্কৃতির প্রসার যেখানে সীমিত সেখানে বাঁশীর ব্যাপারে আপনার ধারণা সীমিত হওয়াই স্বাভাবিক।
বাঁশীর সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য এর সহজ সরল রূপ। কিন্তু বাঁশী বাজানোর প্রারম্ভিক কৌশল অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের চাইতেও কঠিন হওয়ায় মানুষের বাদ্যযন্ত্র হিসাবে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে বাঁশী এখনো পিছিয়ে। বাঁশীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য্য এর মায়াময় সুর। সেই সুর যেন শব্দের এক পবিত্র সাধারণ ফল, ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় বলে এর সম্পর্ক সরাসরি যেন প্রাণের সাথে।
বাংলাদেশে বাঁশীর দুটি ধারা প্রচলিত, একটি লোকগীতির সুরে আরেকটি শাস্ত্রীয় ( Classical) । শাস্ত্রীয় ক্ষেত্রে গত কয়েকযুগে বাঁশী অন্যতম বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ৮০-৯০ দশকে সীমিত বংশীবাদকের মধ্যে প্রতিভার সীমাবদ্ধতা থাকলেও বর্তমানে তরুনপ্রজন্মের কাছে বাঁশী একটি জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র, ইন্টারনেটের যুগে বিশ্বের সব প্রান্তের সুর মানুষের হাতের নাগালে হওয়ায় বাঁশীর বিকাশ ও প্রসার আমাদের দেশে বেড়েছে।
Internet-কে মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়ে আমরা আমাদের Facebook Page এবং Youtube Channel এবং অন্যান্য Analytics এর মাধ্যমে বাঁশী সম্পর্কে মানুষের আগ্রহের বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত পাই, তথ্য অনুযায়ী, ১৮-২৪ বছর বয়সের মানুষের এ ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহ। পুরুষদের তুলনায় নারীদের বাঁশী শিক্ষার আগ্রহ কম। বাঁশী শিক্ষার আগ্রহের ব্যাপারে নারী-পুরুষের অনুপাত নারী ১৩ শতাংশ এবং পুরুষ বাকি ৮৭ শতাংশ।
বাঁশীর ব্যবহার এখন সব রকমের সঙ্গীতেই হয়। বাঁশী নিজেই পরিবেশনার মূল যন্ত্র হিসেবে অন্যান্য যন্ত্রানুষঙ্গসহ মঞ্চে প্রধান ভূমিকা রাখে।
অনেকের কাছে এটি প্রাথমিক ভাবে শখের যন্ত্র মনে হয়। কিন্তু যারা বাঁশীর ব্যাপারে অধ্যয়ন করেন কিংবা শিখেন তারা জানেন সঙ্গীতের অসংখ্য উপাদান বাঁশীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার জন্য নানা কলা-কৌশল রপ্ত করার প্রয়োজন হয় । প্রয়োজন হয় নিয়মিত সাধনার।
বাঁশী সঙ্গীতের অনন্য এক মাধ্যম যা রপ্ত করলে মানুষ জগতকে অনুধাবন করে বিভিন্ন নতুন রূপে।
মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রকে এই কলা প্রসারিত ও বিস্তৃত করতে শিখে, শেখে প্রচলিত একঘেয়ে জীবনকে ভেঙ্গে নতুন রুপে জগতকে আবিষ্কার করতে। এ যেন তখন তার কাছে সাধনা নয় বরং হয়ে উঠে অনন্য এক উপাসনা। তবে আগেই বলছি প্রয়োজন নিয়মিত সাধনার।
বাঁশীর ব্যাপারে অদ্ভুত কিছু সংস্কৃতির এ দেশের মানুষের এখনও রয়েছে। যেমন বাঁশী বাজালে জ্বীন-পরী দেখা যায়। কেউ কেউ ভাবেন বাঁশী বাজালে নিঃশ্বাসের সমস্যা হয় এবং দাঁতের ক্ষতি হয়। বাস্তবতায় বাঁশী বাজালে শ্বাসপ্রশ্বাস এর ক্ষমতা আরও বাড়ে এবং শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। অন্যান্য কুসংস্কারগুলো ভিত্তিহীন।
বাঁশী বা বাঁশী বাজানোকে অসৎ উদ্দেশ্য ব্যবহার না করে মনের প্রশান্তি, বিকাশ, উৎকর্ষতার কাজে লাগালে এবং মানুষের মাঝে শান্তি প্রসারে এর ব্যবহারে নেই কোনো নীতিগত কিংবা ধর্মীয় বিধিনিষেধ এবং তা মূলত জগতকে আরো সুন্দর ও অর্থপূর্ণ করে।
শ্বাসপ্রশ্বাস যখন পরিণত হয় সুরের অমোঘ ধারায় তখন প্রাণের অস্তিত্ব হয়ে ওঠে আরো প্রাণবন্ত।
Copyright: Zubair Malik, Flute Training Centre